পবিত্র মাহে রমজানের রহমতের দশক শেষে আসছে মাগফিরাত বা ক্ষমার দশক। সাওমের মূল লক্ষ্য ও কাঙ্খিত কল্যাণ লাভের মাধ্যমে এ ক্ষমা অর্জন করতে হবে। তাহল অবশ্যই বৈধ পানাহার ও স্ত্রী সঙ্গম থেকে বিরত থাকার সাথে সাথে প্রকাশ্য সব ধরনের পাপাচার ও অ-প্রকাশ্য মন্দাচার থেকে অন্তর ও দেহ তথা সকল অঙ্গ-প্রতঙ্গকে রক্ষা করে এবং বিশুদ্ধ আমল করার মাধ্যমে আমরা যেন জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে পারি ও জান্নাত লাভ করতে পারি। বর্তমান আধুনিক ও ডিজিটাল যুগে যেমনিভাবে নুতন নুতন সমস্যার উদ্ভব হয়, তেমনি রয়েছে তার বিজ্ঞান ভিত্তিক ও শরীয়াহ্ মোতাবেক সুষ্ঠু-সুন্দর সমাধান। নি¤েœ কতিপয় জরুরী মাসয়ালা পেশ করা হল যা মাহে রমজানে রোজার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ।
১। ইনজেকশন ( Injection): ইনজেকশন নিলে রোজা ভাঙবে না। ( জাওয়াহিরুল ফতওয়া) তবে অনেক ডাক্তারের মতে এটি এড়িয়ে চলা ভালো।
২। ইনহেলার (Inhaler): শ্বাসকষ্ট দূর করার লক্ষ্যে তরল জাতীয় একটি ঔষধ স্প্রে করে মুখের ভিতর দিয়ে গলায় প্রবেশ করান হয়, এভাবে মুখের ভিতর ইনহেলার স্প্রে করার দ্বারা রোজা ভেঙ্গে যাবে।( ইমদাদুল ফতওয়া)
৩। এনজিও গ্রাম (Angio Gram): হার্টব্লক হয়ে গেলে উরুর গোড়া দিয়ে কেটে বিশেষ রগের ভিতর দিয়ে হার্ট পর্যন্ত যে ক্যাথেটার ঢুকিয়ে পরীক্ষা করা হয় তার নাম এনজিও গ্রাম। এ যন্ত্রটিতে যদি কোনধরনের ঔষধ লাগানো থাকে তারপরেও রোজা ভাঙ্গবে না। ( ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা)
৪। এন্ডোস কপি (Endos copy): চিকন একটি পাইপ যার মাথায় একটি বস্তু থাকে। পাইপটি পাকস্থলিতে ঢুকানো হয় এবং বাইরে থাকা মনিটরের মাধ্যমে রোগীর পেটের অবস্থা নির্নয় করা হয়। এ নলে যদি কোন ঔষধ ব্যবহার করা হয় বা পাইপের ভিতর দিয়ে পানি/ ঔষধ ছিটানো হয়ে থাকে তা হলে রোজা ভেঙ্গে যাবে, আর যদি কোন ঔষধ লাগানো না থাকে তা হলে রোজা ভাঙ্গবে না। (জাদীদ ফিকহী মাসায়েল)
৫। নাইট্রোগ্লিসারিন (Nitro Glycerin): এরাসল জাতীয় ঔষধ, যা হার্টের জন্য দুই-তিন ফোটা জিহ্বার নিচে দিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখে। ঔষধটি শিরার মাধ্যমে রক্তের সাথে মিশে যায় এবং ঔষধের কিছু অংশ গলায় প্রবেশ করার প্রবল স¤া¢বনা রয়েছে। অতএব- এতে রোজা ভেঙ্গে যাবে। ( জাদীদ ফিকহী মাসায়েল)
৬। লেপারোস কপি (Laparoscopy): শিক জাতীয় যন্ত্র দ্বারা পেট ছিদ্র করে পেটের ভিতরের কোন অংশ বা গোশত ইত্যাদি পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে বের করে নিয়ে আসার জন্য ব্যবহৃত যন্ত্র। এতে যদি ঔষধ লাগানো থাকে তাহলে রোজা ভেঙ্গে যাবে অন্যথায় রোজা ভাঙ্গবে না। ( আল মাকালাতুল ফিকহীয়া)
৭। অক্সিজেন (Oxygen): রোজা অবস্থায় ঔষধ ব্যবহৃত অক্সিজেন ব্যবহার করলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। তবে শুধু বাতাসের অক্সিজেন নিলে রোজা ভাঙ্গবে না। ( জাদীদ ফিকহী মাসায়েল)
৮। মস্তিস্ক অপারেশন (Brain Operation): রোজা অবস্থায় মস্তিস্ক অপারেশন করলে ঔষধ ব্যবহার করা হোক বা না হোক রোজা ভাঙ্গবে না। ( আল মাকালাতুল ফিকহীয়া)
৯। রক্ত নেয়া বা দেয়া (Blood Transaction): রোযা অবস্থায় রক্ত দিলে রোজা ভাঙ্গে না। তাই টেষ্ট বা পরীক্ষার জন্য রক্ত দেওয়া যাবে। তবে এ পরিমান রক্ত দেওয়া মাকরুহ যার কারণে শরীর অধিক দুর্বল হয়ে পড়ে এবং রোজা রাখা কষ্টকর হয়ে যাবে। তাই দুর্বল লোকদের জন্য রোজা অবস্থায় অন্য রোগীকে রক্ত দেওয়া ঠিক নয়। আর এমন সবল ব্যক্তি যে রোজা অবস্থায় অন্যকে রক্ত দিলে রোজা রাখা তার জন্য কষ্টকর হবে না সে রক্ত দিতে পারবে। এতে কোন অসুবিধা নেই। (সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯৩৬,১৯৪০, আলবাহরুর রায়েক২/২৭৩)
১০। সিস্টোসকপি (Cystoscopy): প্রসাবের রাস্তা দিয়ে ক্যাথেটার প্রবেশ করিয়ে যে পরীক্ষা করা হয়।এর দ্বারা রোজা ভাঙ্গবে না। (হেদায়া)
১১। প্রক্টোসকপিঃ (Proctoscopy) পাইলস, পিসার, অর্শ, হারিশ,বুটি ও ফিস্টুলা ইত্যাদি রোগের পরীক্ষাকে প্রক্টোসকপি বলে। মলদ্বার দিয়ে নল প্রবেশ করিয়ে পরীক্ষাটি করা হয়। রোগী যাতে ব্যথা না পায় সে জন্য নলের মধ্যে গ্লিসারিন জাতীয় কোন পিচ্ছল বস্তু ব্যবহার করা হয়। নলটি পুরাপুরি ভিতরে প্রবেশ করেনা। চিকিৎসকদের মতানুসারে ঐ পিচ্ছিল বস্তুটি নলের সাথে মিশে থাকে এবং নলের সাথেই বেরিয়ে আসে, ভেতরে থাকে না। আর থাকলেও তা পরবর্তীতে বেরিয়ে আসে। যদিও শরীর তা চোষে না কিন্তু ঐ বস্তুটি ভিজা হওয়ার কারণে রোজা ভেঙ্গে যাবে। ( ফতওয়ায়ে শামী)
১২। কপার-টি (Coper-T): কপার-টি বলা হয় যোনিদ্বারে প্লাস্টিক লাগানোকে, যেন সহবাসের সময় বীর্যপাত হলে বীর্য জরায়ুতে পৌছতে না পারে। এ কপার-টি লাগিয়েও সহবাস করলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। কাযা কাফফারা উভয়টাই ওয়াজিব হবে।
১৩। সিরোদকার অপারেশন (Shirodkar Operation): সিরোদকার অপারেশন হল অকাল গর্ভপাত হওয়ার আশংকা থাকলে জরায়ুর মুখের চতুষ্পার্শ্বে সেলাই করে মুখকে খিচিয়ে রাখা। এতে অকাল গর্ভপাত রোধ হয়। যেহেতু এতে কোন ঔষধ বা বস্তু রোজা ভঙ্গ হওয়ার গ্রহণযোগ্য খালি স্থানে পৌঁছে না তাই এর দ্বারা রোজা ভাঙ্গবে না।
১৪। ডি এন্ড সি (Dilatation and curettage): ডি এন্ড সি হল আট থেকে দশ সপ্তাহের মধ্যে Dilator এর মাধ্যমে জীবিত কিংবা মৃত বাচ্চাকে মায়ের গর্ভ থেকে বের করে নিয়ে আসা। এতে রোজা ভেঙ্গে যাবে। অযথা এমন করলে কাযা কাফফারা উভয়টি দিতে হবে এবং তওবা করতে হবে। (হদায়া)
১৫। এম.আর (M.R): এম আর হল গর্ভ ধারণের পাঁচ থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে যোনিদ্বার দিয়ে জরায়ুতে এম,আর সিরন্জ প্রবেশ করিয়ে জীবিত কিংবা মৃত ভ্রন নিয়ে আসা। যারপর ঋতু¯্রাব পুনরায় হয়। অতএব মাসিক শুরু হওয়ার কারণে রোজা ভেঙ্গে যাবে এবং কাযা করতে হবে। কিন্তু যদি রাতের বেলা করা হয় তাহলে দিনের রোজা কাযা করতে হবে না। (ফতহুল কাদীর)
১৬। আলট্রাসনোগ্রাম (Ultrasongram): আলট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষায় যে ঔষধ বা যন্ত্র ব্যবহার করা হয় সবই চামড়ার উপরে থাকে, তাই আলট্রাসনোগ্রাম করলে রোজা ভাঙ্গবে না। (হেদায়া)
১৭। স্যালাইন (Saline): স্যালাইন নেয়া হয় রগে, আর রগ যেহেতু রোজা ভঙ্গ হওয়ার গ্রহণযোগ্য রাস্তা নয়, তাই স্যালাইন নিলে রোজা ভাঙ্গবে না, তবে রোজার কষ্ট লাঘবের জন্য স্যালাইন নেয়া মাকরুহ। (ফতওয়ায়ে দারুল উলূম)
১৮। টিকা নেয়া (Vaccine): টিকা নিলে রোজা ভাঙ্গবে না। কারণ, টিকা রোজা ভঙ্গ হওয়ার গ্রহণযোগ্য রাস্তায় ব্যবহার করা হয় না।( আপকে মাসায়াল)
১৯। ঢুস লাগানো ( Douche): ঢুস লাগানো মলদ্বারের মাধ্যমে দেহের ভিতর প্রবেশ করে, তাই ঢুস নিলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। ঢুস যে জায়গা বা রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করে এ জায়গা বা রাস্তা রোজা ভঙ্গ হওয়ার গ্রহণযোগ্য স্থান। (ফতওয়ায়ে শামী)
২০। ইনসুলিন গ্রহণ করা (Insuline): ইনসুলিন নিলে রোজা ভাঙ্গবে না। কারণ, ইনসুলিন রোজা ভঙ্গ হওয়ার গ্রহণযোগ্র রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করে না এবং গ্রহণযোগ্য খালি যায়গায় প্রবেশ করে না। (জাদীদ ফিকহী মাসায়েল)
২১। দাঁত তোলাঃ রোজা অবস্থায় একান্ত প্রয়োজন হলে দাঁত তোলা জায়েয আছে। তবে অতি প্রয়োজন না হলে এমনটা করা মাকরুহ। ঔষধ যদি গলায় চলে যায় অথবা থুঁথু থেকে বেশী অথবা সমপরিমান রক্ত যদি গলায় যায় তাহলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। (আহসানুল ফতওয়া)
২২। পেস্ট, টুথ পাউডার ব্যবহার করাঃ রোজা অবস্থায় দিনের বেলায় টুথ পাউডার, পেস্ট, মাজন ইত্যাদি ব্যবহার করা মাকরুহ। কিন্তু গলায় পৌছলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। ( জাদীদ ফিকহী মাসায়েল)
২৩। মিসওয়াক করাঃ শুকনা বা কাঁচা মিসওয়াক দিয়ে দাঁত মাজার দ্বারা রোজার কোন ক্ষতি হয় না।চাই যখনই করা হোক না কেন। (ফতওয়ায়ে শামী)
২৪। মুখে ঔষধ ব্যবহার করাঃ মুখে ঔষধ ব্যবহার করে তা গিলে ফেললে বা ঔষধ অংশ বিশেষ গলায় প্রবেশ করলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। গলায় প্রবেশ না করলে রোজা ভাঙ্গবে না।( ফতওয়ায়ে শামী)
২৫। রক্ত পরীক্ষার জন্য রক্ত দেয়াঃ রক্ত দেয়া যার দ্বারা শরীরে দুর্বলতা আসে, তা মাকরুহ।
২৬। ডায়াবেটিস মাপাঃ ডায়াবেটিস মাপার জন্য সুচ ঢুকিয়ে যে একফোটা রক্ত নেয়া হয, এতে রোজার কোন ক্ষতি হবে না।
২৭। নাকে ঔষধ দেয়াঃ নাকে পানি বা ঔষধ দিলে যদি খাদ্য নালীতে চলে যায়, তাহলে রোজা ভেঙ্গে যাবে এবং কাযা করতে হবে। (ফতওয়ায়ে শামী)
২৮। চোখে ঔষধ বা সুরমা ব্যবহার করাঃ চোখে ঔষধ বা সুরমা ব্যবহার করার দ্বারা রোজা ভাঙ্গবে না। যদিও এগুলোর স্বাদ গলায় অনুভব হয়। (হেদায়া)
২৯। কানে ঔষধ প্রদান করাঃ কানে ঔষধ,তেল ইত্যাদি ঢুকালে রোজা ভেঙ্গে যাবে। তবে গোসল করার সময় অনিচ্ছায় যে পানি কানে ঢুকে তাতে রোজা ভাঙ্গবে না। অবশ্য এ ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে, যেন পানি গলায় না চলে যায়্ (মাকালাতুল ফিকহীয়া)
৩০। নকল দাঁত মুখে রাখাঃ রোজ রেখে নকল দাঁত মুখে স্থাপন করে রাখলে রোজার কোন ক্ষতি হয় না। ( ইমাদাদুল ফতওয়া)

লেখক- মো: আবু জাফর, অধ্যক্ষ, টিকিকাটা নূরীয়া ফাজিল মাদ্রাসা, মঠবাড়িয়া, পিরোজপুর।

Comments

comments