মক্কা-মদীনা আমার জীবনের সেরা সফর

রিয়াদের বাসা থেকে মদিনা ৮শ ৪৫ কিলোমিটার পথ আমরা পাড়ি দিলাম। মাঝে পথে থেমে খেয়েছি। রাস্তা এতটাই ভাল যে ১শ মাইল বেগে গাড়ি চলল কিন্তু আমরা টেরও পেলাম না। সড়কের দুই পাশে ধূ ধূ মরুভূমি, পাথুরে পাহাড়, মাঝে মাঝে খেজুর গাছ, কিছু উট আর ভেড়া চড়ে বেড়াচ্ছে। অনেক কাজ চলছে সারাটা পথ জুড়েই। পাথরের পাহাড় কেটে উন্নয়ন কাজ চলছে। বাস গাড়ি সব একেবারে লেটেস্ট মডেলের।
ইসলামের পথচলা শুরু হয, এই পবিত্র মদীনা থেকে। মদীনা অনেকটাই সবুজ। আমরা মসজিদ কুবাতে পৌঁছাই রাত ৩ টায়। আমরা নফল সালাত আদায় করি। তারপরে চলে যাই উহুদ পাহাড়। ইসলামের ইতিহাসের সঙ্গে এই পাহাড়ের নাম বিশেষভাবে জড়িয়ে আছে। মসজিদে নববি থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে মদিনার ঠিক উত্তর-পূর্ব দিকে ঐতিহাসিক এই পাহাড়টির অবস্থান। উহুদ প্রান্তরে কোরায়েশরা নির্মমভাবে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দাঁত মোবারক শহিদ করেছিল, তাকে আহত করেছিল। এই রণক্ষেত্রে নবী করিম (সা.)-এর চাচা মহাবীর হজরত হামজা (রা.) এবং হজরত আকিল ইবনে উমাইয়া (রা.) সহ সত্তরজন সাহাবা শহিদ হয়েছিলেন। হাদিসে এই পাহাড় সম্পর্কে প্রচুর বর্ণনা রয়েছে। এক বর্ণনায় নবী করিম (সা.) বলেন, ‘উহুদ পাহাড় আমাদের ভালোবাসে, আমরাও উহুদ পাহাড়কে ভালোবাসি।’ এ ছাড়া অনেক হাদিসে, সওয়াবের পরিমাণ বুঝাতে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) উদাহরণ হিসেবে বলেছেন উহুদ পাহাড়ের কথা।
নবীজির রওজা: ওমরা পালনকারীদের মদিনা আসার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো- নবী করিম (সা.)-এর রওজা মোবারক জিয়ারত করা, রওজায় সালাম পেশ করা। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে আমার রওজা জিয়ারত করলো, তার জন্য আমার সুপারিশ ওযাজিব হয়ে গেলো।-সহিহ মুসলিম
নবী করিম (সা.) আরও বলেন, যে হজ করলো কিন্তু আমার রওজা জিয়ারত করলো না; সে আমার প্রতি জুলুম করলো।- তিরমিজি
নবীজির রওজা শরীফ, মসজিদুল নববীর ভেতর এর অবস্থান। মসজিদের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে গাঁঢ় সবুজ গম্বুজের নীচে নবীজির রওজাটি ঠিক যেখানে অবস্থিত, সেখানেই বাসা ছিল বিবি আয়েশার, নবীজির স্ত্রী। বিবি আয়েশাকে বলা হতো ‘বিশ্বাসীদের মা’। রাসুলের সমাহিত হওয়ার স্থানে যেতে হলে বহুদূর হেঁটে ২৬ নম্বর গেট দিয়ে ঢুকতে হবে। মসজিদে নববিতে প্রবেশের অনেকগুলো দরজা রয়েছে। এর মধ্যে পশ্চিম পাশে রাসূলের রওজা জিয়ারতের জন্য যে দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে হয়, ওই দরজাকে ‘বাবুস সালাম’ বলা হয়। বাবুস সালাম দিয়ে প্রবেশ করে রাসূলের রওজায় সালাম শেষে ‘বাবুল বাকি’ দিয়ে বের হতে হয়।
ফজরের নামাজের পরে আমরা গিয়েছিলাম মদিনা মুনাওয়ারা’-এর কবরস্থান -জান্নাতুল বাকি। এক মৃত্যু ব্যক্তি কে দাফন দেয়ার ভাগ্য হয়েছিলো। কবরস্থান’র চতুর্দিকে একটি উঁচু বাউন্ডারি। পশ্চিম দিকে একটি বড় গেইট। কবরস্থানে যাওয়ার জন্য একটি প্রশস্ত সিঁড়ি। ফজরের পরে এবং আসরের পরে কবরস্থান সবার যিয়ারতের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। বাহিরে পুলিশের লোকজন অবস্থান করে এবং ভেতরেও শক্তভাবে নজরদারি করা হয়, কোনো প্রকার বেদাতি কাজ শুরু করলে, তা শক্তহাতে দমন করা হয়।
জুম্মার নামাজ স্রোতের মতো মানুষ আসছে। বিশাল এলাকা নিয়ে মসজিদুল নববীর অবস্থান। আজানের আগে থেকেই মানুষ এসে ভীড় জমাতে থাকে। কাজেই জায়গা পেতে হলে বেশ আগেই মসজিদে যেতে হবে।
মসজিদুল নববীর আশেপাশে অনেক পুরনো ও বড় বড় মার্কেট এবং অনেক হোটেল আছে। আশেপাশের সব দোকানগুলো দেখলাম আজানের সাথে সাথে বিক্রিবাট্টা বন্ধ করে নামাজের জন্য তৈরি হয়ে গেল এবং দোকান ফাঁকা রেখেই নামাজে চলে গেল।
জুম্মার নামাজ শেষে আমরা মক্কার উদ্দেশে রওনা হলাম। ওমরার জন্য নির্ধারিত স্থান অতিক্রম করার পূর্বে ইহরাম বাঁধা ফরজ। সুতরাং নির্দিষ্ট স্থান অতিক্রম করার পূর্বে ইহরাম না বাঁধলে ওমরা আদায় হবে না। ওমরা পালনকারীদের জন্য নির্দিষ্ট স্থান (মিকাত) থেকেই ফরজ কাজ ইহরাম বাঁধতে হয়। রাত ১০টায় পৌঁছেছিলাম সৌদি আরবের মক্কা নগরীতে। সেখানে গিয়ে হোটেলে লাগেজ রেখেই ছুটে চললাম। মসজিদের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখের সামনে চলে এল কাবা ঘর। মনে মনে দোয়া করছি আল্লাহর দরবারে। ওমরাহর অংশ হিসেবে মাতাফে গিয়ে হাজরে আসওয়াদকে বাঁ দিকে রেখে তাওয়াফ শুরু করলাম। সাত পাক ঘুরে একটি তাওয়াফ সম্পন্ন করলাম। প্রতি পাকের শুরুতে ও শেষে নির্ধারিত দোয়া পড়েছি।
লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা ওয়াননি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাকা’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি তোমার দরবারে হাজির, আমি তোমার দ্বারে উপস্থিত, আমি হাজির, তোমার কোনো অংশীদার নেই, তোমার দরবারে উপস্থিত হয়েছি। নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা ও নিয়ামতের সামগ্রী সবই তোমার, (সর্বযুগে ও সর্বত্র) তোমারই রাজত্ব, তোমার কোনো অংশীদার নেই।
সবচেয়ে আনন্দের বিষয় ছিল, তাওয়াফের সময় হাজরে আসওয়াদ পাথরে চুমু খাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তাওয়াফ শেষ করে ওমরাহর রীতি অনুসারে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে দোয়া করলাম, তারপর কাবার দরজা ও গিলাফ ধরে দোয়া করলাম। তারপর জমজমের পানি খেয়ে গেলাম সাফা-মারওয়া পাহাড়ের উদ্দেশে। সেখানেও নিয়ম অনুযায়ী দুই পাহাড়ে সাতটি দৌড় দিলাম। সব শেষে মসজিদ থেকে বের হয়ে মাথা ন্যাড়া করে ওমরাহ আনুষ্ঠানিকতা শেষ করলাম।
আমি, আমার আব্বু, কাকা একসাথে ওমরাহ পালন করেছি। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই।
লেখক: রুবেল মিয়া নাহিদ
Comments
আরও পড়ুন





